উন্মুক্ত স্থানে টাঙানো হবে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা

Voice of Dhaka
আপডেটঃ ডিসেম্বর ১৫, ২০২৪ | ১০:২৫ পূর্বাহ্ণ                             ই-প্রিন্ট ই-প্রিন্ট
Voice of Dhaka
আপডেটঃ ডিসেম্বর ১৫, ২০২৪ | ১০:২৫ পূর্বাহ্ণ                             ই-প্রিন্ট ই-প্রিন্ট
Link Copied!

নিজস্ব প্রতিবেদক : গেজেটভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা উন্মুক্ত স্থানে টাঙানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রতিটি জেলা-উপজেলায় সরকারি অফিসের নোটিশ বোর্ডের পাশাপাশি উন্মুক্ত স্থানে (পাবলিক প্লেস) এই তালিকা টাঙিয়ে দেওয়া হবে। যাতে স্থানীয় জনগণ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে অবগত হতে পারে; কারো বিরুদ্ধে ‘অমুক্তিযোদ্ধা’ বা ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’র অভিযোগ থাকলে সে বিষয়ে যেকোনো নাগরিক অভিযোগ জানাতে পারেন। যাচাই শেষে অভিযোগ প্রমাণিত হলে বাতিল করা হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মুক্তিযোদ্ধার গেজেট ও সনদ। বন্ধ হবে সরকারি ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কেউ মুক্তিযোদ্ধা হলে তার বিরুদ্ধে প্রতারণার দায়ে মামলা হবে। ফেরত দিতে হবে ভাতাসহ সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা। তবে কেউ স্বেচ্ছায় নিজের দোষ স্বীকার করে গেজেট বাতিলের আবেদন করলে তাকে সহায়তা দেবে সরকার। এ ক্ষেত্রে তাকে দায়মুক্তি দেওয়া হবে।
এই পদক্ষেপের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী। শনিবার তিনি বলেন, ‘আগের সরকারের তালিকা অনুযায়ী গেজেটভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেওয়া হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে অমুক্তিযোদ্ধা হওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তাদের ভাতা স্থগিত করা হয়েছে।
আমরা ওয়েবসাইটে অমুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ চেয়েছি। এ পর্যন্ত স্বল্পসংখ্যক আবেদন পেয়েছি। কাঙ্ক্ষিত সাড়া মিলছে না। আমাদের উপদেষ্টা মহোদয় এরই মধ্যে অমুক্তিযোদ্ধাদের স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকার করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। যারা স্বেচ্ছায় নিজের দোষ স্বীকার করবে, তাদের আমরা সম্মান দেব। দায়মুক্তি দেওয়া হবে।’
তিনি আরো বলেন, “এ ছাড়া আমরা চাই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্ত করতে স্থানীয় জনগণ সরকারকে সহায়তা করুক। এ জন্য প্রতিটি জেলা-উপজেলায় সরকারি অফিসের নোটিশ বোর্ডের পাশাপাশি উন্মুক্ত স্থানে এ তালিকা টাঙিয়ে দেওয়া হবে। যাতে স্থানীয় জনগণ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে অবগত হতে পারে। কারো বিরুদ্ধে ‘অমুক্তিযোদ্ধা’ বা ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’র অভিযোগ থাকলে সে বিষয়ে যেকোনো নাগরিক অভিযোগ জানাতে পারে।
যাচাই শেষে অভিযোগ প্রমাণিত হলে বাতিল করা হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মুক্তিযোদ্ধার গেজেট ও সনদ। বন্ধ হবে সরকারি ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কেউ মুক্তিযোদ্ধা হলে তার বিরুদ্ধে মামলা হবে। ফেরত দিতে হবে ভাতাসহ সরকারি সুযোগ-সুবিধা।” ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এর তিন দিন পর গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পান বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক। এরপর গত ১৫ আগস্ট সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি ও আধাসরকারি চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্তদের একটি তালিকা তৈরি হবে। সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কতজনের চাকরি হয়েছে, এখানে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা এবং মুক্তিযুদ্ধ না করে যারা মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এর পরই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্ত করতে নানা উদ্যোগ শুরু করে মন্ত্রণালয়। তৈরি হয়েছে ‘অমুক্তিযোদ্ধা শনাক্তকরণ অভিযোগ ফরম’। এ ফরম মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অমুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সরকারের কাছে অভিযোগ করা যাবে। এরই মধ্যে কয়েক শ অভিযোগ জমা হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। তবে কাঙ্ক্ষিতসংখ্যক অভিযোগ না পাওয়ায় বিকল্প চিন্তা করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটসহ সব সরকারি দপ্তরের ওয়েবসাইটেই গেজেটভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলার ওয়েবসাইটে সেই উপজেলার সম্মানি ভাতাপ্রাপ্ত সূর্যসন্তানদের নামের তালিকা রয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ জনগণ সেটা জানে না। এমনকি অনেক শিক্ষিত মানুষও জানেন না তার উপজেলায় কতজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এখনো বেঁচে আছেন।
বেশির ভাগ মানুষ সরকারি এসব ওয়েবসাইটের খবর রাখে না। ইন্টারনেট ব্যবহারেও তারা অভ্যস্ত নয়। তাই সংশ্লিষ্ট উপজেলার কতজন বীর মুক্তিযোদ্ধা সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, তারও খবর রাখে না সাধারণ মানুষ। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাধারণ জনগণের সঙ্গে পরিচিত করতে উপজেলা পর্যায়ে জনবহুল উন্মুক্ত স্থানে তাদের নাম ও স্থায়ী ঠিকানা সংবলিত তালিকা টানিয়ে দেওয়া হবে। যাতে সাধারণ মানুষ তাদের সম্পর্কে জানতে পারে। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ না করেও যদি কেউ জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা হয়, তার বিষয়েও স্থানীয় জনগণ যাতে অভিযোগ দিতে পারে, সে ব্যবস্থাও রাখা হবে। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের নোটিশ বোর্ডেও মুক্তিযোদ্ধার তালিকা টানিয়ে দেওয়া হবে। মোট কথা জনবহুল বা জনসমাগম হয় এমন স্থানে প্রকাশ্যে টানিয়ে দেওয়া হবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা।
দেশে সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাও নতুন করে করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকারের আমলে ছয়বার এ তালিকা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৪ সালে নতুন করে চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। এ জন্য অনলাইনের মাধ্যমে ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত গ্রহণ করা হয় প্রায় দেড় লাখ ব্যক্তির আবেদন।
২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি উপজেলা পর্যায়ে আবেদনকারীদের যাচাই-বাছাই শুরু হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে আরো যে পাঁচ দফা মুক্তিযোদ্ধার তালিকা হয়েছিল, সেই তালিকাও তখন যাচাই করা হয়। দীর্ঘ যাচাই-বাছাই শেষে ২০২৩ সালের মার্চে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করে মন্ত্রণালয়। তাতে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এক লাখ ৯৭ হাজার ৮৫৫। খেতাবপ্রাপ্ত, শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন আরো ১০ হাজার ৯৯৬ জন। এর মধ্যে ভাতাভোগী মুক্তিযোদ্ধা এক লাখ ৯৬ হাজার ৪৫৪ জন। তাদের মধ্যে জীবিত ৯১ হাজার ৫৫ জন।

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক একাধিকবার গণমাধ্যমকে বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে তুঘলকি ব্যাপার হয়েছে। তালিকায় স্থান পেয়েছে অমুক্তিযোদ্ধাও, যারা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। জনমনে অনেক প্রশ্ন আছে। তাই মুক্তিযোদ্ধার তালিকাটা ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত যাচাই-বাছাই করা হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি সাধারণ জনগণ তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে যেকোনো অমুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে পারবে। এ জন্য অভিযোগ ফরমও তৈরি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য তালিকা তৈরিই আমাদের লক্ষ্য।
সর্বশেষ বুধবার (১১ ডিসেম্বর) মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত করে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা সনদ বাতিল করে সরে গেলে সাধারণ ক্ষমা পাবে। উপদেষ্টা বলেন, ‘বহু অভিযোগ আছে যে মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও অনেকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তালিকাভুক্ত হয়েছে, গেজেটভুক্ত হয়েছে এবং সুবিধা গ্রহণ করছে। আমার দৃষ্টিতে এটি জাতির সঙ্গে প্রতারণা। এটি ছোটখাটো অপরাধ নয়, অনেক বড় অপরাধ। ১২ বছর ছয় মাসের কম বয়সী দুই হাজার ১১১ জন মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করার পর এই বিষয়ে আদালতে মামলা চলছে।’
যারা সাড়ে ১২ বছরের কমবয়সী মুক্তিযোদ্ধা :
জামুকা সূত্র জানায়, তাদের ৭৫তম সভায় আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাঁর জন্ম ১৯৬২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। সে হিসাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় তাঁর বয়স ১০ বছরের কম ছিল। বিষয়টি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বরগুনার আমতলীর সৈয়দ মো. মাসুমের বয়স ছিল নয় বছর ১ মাস ১২ দিন। তার গেজেট নম্বর-৪২৩। তবে সৈয়দ মো. মাসুম নিজেকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে বলেন, এসএসসি সনদ অনুসারে জন্ম তারিখ ১৯৬২ সাল হলেও আমার প্রকৃত জন্ম তারিখ ১৯৫৬ সাল। মুক্তিযুদ্ধের ৯ বছর পর জন্ম নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন মো. মীজানুর রহমান। তাঁর মা-বাবার বিয়েও হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পর। মীজানুর রহমানের বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার হাজিগাঁও গ্রামে। বাবার নাম আবদুল মজিদ, মা দিলরুবা খানম। তাঁদের বিয়ে হয়েছে ১৯৭৮ সালে। এর দুই বছর পর ১৯৮০ সালের ৩ জুলাই জন্ম হয় মীজানুর রহমানের। মীজানুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় কিভাবে তাঁর নাম এসেছে সেটা তিনি জানেন না। এ ধরনের প্রায় দুই হাজারের বেশি ব্যক্তি রয়েছেন, যারা সাড়ে ১২ বছরের কম বয়সী মুক্তিযোদ্ধা।

ট্যাগ: