ব্যবসায়ীরা গ্রেফতার আতঙ্কে
বিশেষ প্রতিবেদক : ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থক বা সরাসরি পদধারী কয়েকজন ব্যবসায়ী গত দুই মাসে গ্রেফতার হয়েছেন। অন্যরাও খুব স্বস্তিতে নেই। তাদেরও কাটছে না গ্রেফতার আতঙ্ক, যা ব্যবসা ও নতুন বিনিয়োগকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতারা। এতে আরও থমকে যেতে পারে কিছুটা ধুঁকতে থাকা ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি। আওয়ামী লীগের পতনের পর কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন। গ্রেফতারদের অধিকাংশই ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলেও অন্য ব্যবসায়ীদের জন্যও বিষয়টি উদ্বেগের। এসব ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানে কাজ করে হাজার হাজার মানুষ। তাদের গ্রেফতারে যদি ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে তার প্রভাব পুরো অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে পড়বে। যেটা কারও জন্যই খুব সুখকর হবে না। তবে প্রকৃত অপরাধী বা দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের শাস্তির বিষয়ে সবাই একমত, তবে সেটা প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতি না করে।
এটা ঠিক নয় যে সব ব্যবসায়ী দুর্নীতিগ্রস্ত বা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। অন্যদিকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা দুর্নীতিবাজ- এটাও ঠিক নয়। আমরা বিষয়গুলো সাধারণীকরণ করছি, যা আমাদের ইমেজ সংকটে ফেলেছে।- বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান। ৫ আগস্টের পর গ্রেফতারদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি মো. আতিকুল ইসলাম, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য আবদুস সালাম মুর্শেদী। তবে সালমান এফ রহমান ও নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ অনেক ব্যবসায়ী আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ক্ষমতাচ্যুত সরকার ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যান। সরাসরি বড় পদে না থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন কমিটিতে সক্রিয় ছিলেন তারা। ফলে কিছুটা হলেও ব্যবসায়ীদের স্বাভাবিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রপ্তানিমুখী ব্যবসায়ী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় গ্রেফতার আতঙ্কে আছি। কিন্তু আমি কোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করিনি। যদি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আমার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অপরাধ প্রমাণ করতে পারে, আমি বিনা দ্বিধায় যে কোনো ধরনের শাস্তি গ্রহণ করতে রাজি। কিন্তু সঠিক তদন্ত বা প্রমাণ ছাড়া এটা করলে ক্রেতাদের কাছে এবং সমাজে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত করবে, যেখানে শত শত লোক কাজ করে।’ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বিনিয়োগে ধীরগতি এবং নতুন বিনিয়োগে আস্থা ক্ষয় হওয়ার আশঙ্কা করছেন। তারা মনে করেন, বিষয়গুলো সতর্কতার সঙ্গে পরিচালনা করা উচিত।
‘এটা ঠিক নয় যে সব ব্যবসায়ী দুর্নীতিগ্রস্ত বা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। অন্যদিকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা দুর্নীতিবাজ- এটাও ঠিক নয়। আমরা বিষয়গুলো সাধারণীকরণ করছি, যা আমাদের ইমেজ সংকটে ফেলেছে।’ এ মন্তব্য করেন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান।
তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় ন্যায়বিচার ও প্রকৃত অপরাধীর শাস্তির পক্ষে। যদি কোনো ব্যবসায়ী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকেন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতি করেন, তাহলে তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু ব্যবসা সচল রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
ব্যবসায়ী নেতারা মনে করেন তাদের রাজনীতি নয়, ব্যবসায়ী পরিচয় মূল্যায়ন করা উচিত। বিজিএমইএর সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি আবদুল্লাহিল রাকিব বলেন, ‘রাজনৈতিক মতাদর্শ যাই হোক না কেন, একজন উদ্যোক্তাকে রাজনৈতিক ব্যক্তির পরিবর্তে ব্যবসায়ী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। যদি একজন ব্যবসায়ীকে রাজনৈতিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে এটি তার প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করতে পারে, যেখানে কয়েকশ বা হাজার হাজার লোক কাজ করে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত এমন একজনকেও আমাদের রেহাই দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু একটি যুক্তি আছে যে আমাদের সেই লোকদের ব্যবসা বন্ধ করা উচিত নয়। কারণ এটি অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থানের ক্ষতি করবে।’
‘ন্যায়বিচারের মাধ্যমে সরকারকে ব্যবসায়িক পরিবেশে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে হবে। সরকারকে সুস্পষ্ট বার্তা দিতে হবে যে তারা রাজনৈতিক বিবেচনা করবে না বরং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে। দুর্নীতিবাজদের শাস্তি না হলে তা অন্যদের অন্যায় কাজে উৎসাহিত করবে। দুর্নীতিবাজদের দমন ও ভালো ব্যবসায়ীদের পুরস্কৃত করার এখনই সময়।’ তিনি যোগ করেন। একইভাবে নতুন বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করার জন্য সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।